মাহে রমজান আত্মশুদ্ধি, মানসিক উত্কর্ষ সাধন ও দৈহিক সুষমা পূর্ণতার মাস। এ মাসেই মুমিন আধ্যাত্মিক সাধনায় চরম উত্কর্ষ লাভ করেন। আর এ মাসেই রয়েছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। সেই রাতের পূর্ণ সওয়াব লাভ করার জন্য ইতিকাফের গুরুত্ব ও উপকারিতা অপরিসীম। ইতিকাফ আরবি শব্দ। ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা, বসা, বিশ্রাম করা, ইবাদত করা ইত্যাদি। ইবাদতের নিয়তে মসজিদ বা নির্জন স্থানে বসা বা অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উত্কর্ষ সাধনের লক্ষ্যে, আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য মাহে রমজানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরুষরা মসজিদে, মহিলারা নিজ গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মুয়তাকিফ বলে। ইতিকাফ যে কোনো সময় করা যায়। তবে মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নত। কেউ যদি একদিনের জন্য হলেও আল্লাাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করেন তবে তিনিও ইতিকাফের সওয়াব লাভ করবেন। ইতিকাফের মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আর মাহে রমজানে ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উত্কর্ষ সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য সুসম্পর্ক স্থাপন করা।
ইতিকাফ ৩ প্রকার। যথা- ১. ওয়াজিব, ২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, ৩. নফল ইতিকাফ।
১. ওয়াজিব ইতিকাফ : কোনো কারণবশত যদি কেউ ইতিকাফের নিয়ত বা মান্নত করে তা আদায় করা ওয়াজিব। রোজাসহ এইরূপ ইতিকাফ আদায় বা পালন করা আবশ্যক।
২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ : যা মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন করা হয়। মসজিদ এলাকার কিছুসংখ্যক লোক ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকেই আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই যদি আদায় না করে তবে সবাই গুনাহগার হবে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সবসময় রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।
৩. নফল ইতিকাফ : নফল ইতিকাফের জন্য কোনো মাস বা নির্ধারিত সময়ের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো মাসে যে কোনো সময়ে এই নফল ইতিকাফ করা যায়।
মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফ আত্মিক উত্কর্ষ সাধন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। লাইলাতুল কদরের পূর্ণ ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা হয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে রাসূল (সা.) মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করেছেন। যে ব্যক্তি যত বেশি গভীরভাবে আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য আত্মনিয়োগ করবে, সে তত বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হবে। মানুষ একান্তভাবে আল্লাহর ধ্যানে নিয়োজিত থাকার প্রধান মাধ্যম হলো ইতিকাফ। ইতিকাফ মানুষের ওপর এমন আধ্যাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন হয়। ইতিকাফের মাধ্যমে মানুষ অধিক নেকি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক হয়। আর এই ইতিকাফ মুমিন মুত্তাকিনদের জীবনের মুক্তির বিশেষ পাথেয়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর কোনো বিশেষ কারণবশত ইতিকাফ করতে পারেননি তাই পরবর্তী বছর শেষ ও মধ্যবর্তী দু’দশকসহ মোট ২০ দিন ইতিকাফ আদায় করে নিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন ইতিকাফের ইচ্ছা করতেন তখন তিনি ফজরের নামাজ পড়ে ইতিকাফে নির্ধারিত স্থানে প্রবেশ করতেন।
ইতেকাফের ফজিলত সংক্রান্ত অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, তাকে এক ওমরা পরিমাণে সওয়াব দেয়া হবে। অপর হাদিসে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, তার আমলনামায় দুটি হজ বা দুটি ওমরা হজের সওয়াব লিখে দেয়া হবে। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি সারাজীবনে একদিনের জন্য হলেও ইতিকাফ করবে কেয়ামতের দিন তার নিকট থেকে দোযখ ১৫শ’ বছরের পথ দূরে থাকবে। একদিনের ইতিকাফের ফজিলত যদি এমন হয় তবে ১০ দিন, ২০ দিন ও ৩০ দিনের ফজিলত কতটুকু হতে পারে তা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কেউই অবগত নন। রাসূল (সা.) বলেন, ইতিকাফকারী সব গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। মসজিদের বাইরে যত মানুষ যত ইবাদত ও নেক আমল করে থাকে ইতিকাফকারী তা না করতে পারার কারণে মহান আল্লাহতায়ালা দয়া করে তার আমলনামায় ওইসব নেক আমলের সাওয়াব লিখে দেন। ইতিকাফের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মাহে রমজানের সর্বশ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর খোঁজ করা। কারণ এটি কোন রাতে তা নির্দিষ্ট নয়। বিশেষ করে মাহে রমজানের শেষ দশকের যে কোনো বিজোড় রাতেই তা হতে পারে। যারা ইতিকাফ অবস্থায় থাকেন তারা ইবাদতে বিশেষ মনোযোগী হন। ফলে যে কোনো রাতে তা অনুষ্ঠিত হবে ইতিকাফকারী তার পূর্ণ ফজিলত পেয়ে যাবেন। মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ সুন্নাতে মোয়াক্কাদায়ে কেফায়া।
মসজিদের এক কোণে স্থান নির্ধারণ করে পর্দা করে একটি কামরা বা রুম তৈরি করে নিতে হয়, যা জামাতের সময় সরানো সম্ভব হয়। এখানেই তার পানাহার, শয়নসহ যাবতীয় কর্মসম্পাদন করতে হবে। প্রস্রাব-পায়খানা এবং অজু-গোসলের প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে যাওয়া নিষেধ। আর বিশেষ করে ওই কাজগুলো মসজিদ এলাকার মধ্যেই হতে হবে। মহিলাদের গৃহের অভ্যন্তরে ইতিকাফ করা নফল। আর পুরুষদের জামে মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাত। ইতিকাফের পূর্বে নিয়ত করে নেবে, ‘নাওয়াইতু আন-সুন্নাতুল ইতিকাফ মা দুমতু হাযাল মাসজিদ’। অর্থাত্ ‘আমি এই মসজিদে অবস্থান করত ইতিকাফের নিয়ত করছি।’ ইতিকাফ অবস্থায় পায়খানা, প্রস্রাব এবং অজু-গোসলের জন্য বাইরে যেতে পারবে। তবে অতি তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। মসজিদের পূর্ণ ইহতেরাম রক্ষা করে চলতে হবে। সার্বক্ষণিক আল্লাহ ধ্যান-খেয়াল ও ইবাদতে লিপ্ত থাকতে হবে। অযথা গল্প-গুজব ও বাজে পায়চারী বর্জনীয়।
ইতিকাফ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সুসম্পর্ক গড়ে তোলার এক প্রধান মাধ্যম। যার ফলে সারাবিশ্বের সব পীর, অলী, আউলিয়া, গাউছ, কুতুবগণসহ তাদের মুরিদ ও ওলামায়ে কেরামগণ মাহে রমজানের শেষ দশককে নিজের জন্য ঠিকানা বা স্থান নির্ধারণ করে নেয় আল্লাহর ঘর মসজিদকে। তারা দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর ধ্যানে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করে। আসুন আমরাও ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সাধনায় আত্মনিয়োগ করি।
No comments :
Post a Comment