কোরআনে রমজান মাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, রমজান হলো সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। আর কোরআনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোরআন হলো মানুষের জন্য হেদায়াত এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। এখানে দু’টি বিষয় আছে। প্রথম : রমজান হলো কোরআন নাজিল হওয়ার মাস। দ্বিতীয় : কোরআন হলো মানুষের জন্য হেদায়াত, যা হক ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে।
এ হিসেবে রমজান হলো কোরআন নাজিল হওয়ার বার্ষিকী। আমরা অনেক ধরনের বার্ষিকী পালন করি। জাতীয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস—এ ধরনের অনেক দিবস উদযাপন করি ও বার্ষিকী পালন করি। আর এসব বার্ষিকী যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তা পালন করা হয় মাত্র একদিন। কোনো বার্ষিকীই একদিনের বেশি পালন করা হয় না। কিন্তু কোরআন নাজিল হওয়ার যে বার্ষিকী, তা পালন করা হয় দীর্ঘ এক মাসব্যাপী। এটা হলো গোটা বিশ্বে বার্ষিকী পালনের অনন্য ব্যতিক্রম।
আমরা বিভিন্ন বার্ষিকীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা সভা করি। অনেক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, আনন্দ-ফুর্তি হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়, ছুটি থাকে ইত্যাদি। কিন্তু কোরআন নাজিল হওয়ার বার্ষিকী হলো সম্পূর্ণরূপে অন্য ধরনের। এখানে আনন্দ-ফুর্তি নেই, কর্মবিরতি নেই, বরং আছে আরও বেশি কাজ। আছে আনন্দ-ফুর্তির পরিবর্তে কৃচ্ছ্রতা ও আত্মসংযমের অনুশীলনী। এখানে খাওয়া-দাওয়ার পরিবর্তে উপোস করতে হয়। জৈবিক আনন্দের পরিবর্তে সংযমী হতে হয়। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও যৌনমিলন নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন, দুনিয়ার অন্যান্য বার্ষিকী উদযাপনের চেয়ে তা এতো ভিন্নরূপ কেন? কোরআন হলো মুসলমানের জন্য একটি অতি মূল্যবান দলিল। যে হেদায়াতের জন্য এ কোরআন, তা পাওয়ার একটা শর্ত আছে। কোরআনের বার্ষিকীতে এমন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে, যা সে শর্ত পূরণে সাহায্য করে। অর্থাত্ কোরআন থেকে হেদায়াত লাভের জন্য যা প্রয়োজন, তা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এ বার্ষিকী পালন করার মাধ্যমে।
কোরআন হলো মানুষের জন্য হেদায়াত, দিকনির্দেশনা ও সরল-সহজ পথের রোডম্যাপ হওয়া সত্ত্বেও সবাই সে হেদায়াত লাভ করতে পারবে না। কোরআন থেকে তারাই উপকৃত হতে পারবে, যাদের মধ্যে তাকওয়া আছে। তাকওয়া হলো কোরআন থেকে হেদায়াত লাভের জন্য শর্ত। সেহেতু কোরআনে বলা হয়েছে, এ কোরআন হলো তাকওয়ার অধিকারী মানুষের জন্য হেদায়াত।
তাকওয়ার অর্থ ব্যাপক। এর অর্থ আল্লাহভীতি। এর অর্থ এমন সদা-সতর্ক মানসিক অবস্থা, যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের বিবেককে শক্তিশালী করে এবং প্রবৃত্তিকে দমন করে।
এখন প্রশ্ন, কোরআনের বার্ষিকী রমজানের মাধ্যমে এ তাকওয়া কীভাবে সৃষ্টি হয়? এক মাসব্যাপী রমজানের কর্মসূচি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে মানুষের জন্য দু’টি কর্মসূচি আছে : বর্জন ও অর্জন। রমজান মাসে দিনের বেলায় শুধু পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করলেই হয় না, বরং দিন ও রাত উভয় বেলায় সব প্রকার মন্দ কাজ পরিত্যাগ করতে হয়। আত্মসংযম করতে হয়। দিনে ক্ষুধা আছে, হালাল খাবার আছে, কিন্তু তাও গ্রহণ করা যাবে না। অর্থাত্ হালাল জিনিসও বর্জন করে সব ধরনের হারাম জিনিস বর্জনের ট্রেনিং নিতে হয়। হালাল জিনিসও বর্জন করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলনী গ্রহণ করতে হয়, যাতে রমজান এবং তার বাইরে কোনো মন্দ জিনিস অথবা খারাপ জিনিস গ্রহণ করার ইচ্ছাও না হয়।
জৈবিক চাহিদা মিটানোর জন্য স্বামী-স্ত্রীর মিলন বৈধ। কিন্তু রোজার সময় তা থেকেও বিরত থেকে নিজের প্রবৃত্তি ও পশুত্বের গুণকে নিয়ন্ত্রণ করার অনুশীলনী করা হয়, যেন বৈধতার বাইরে কোনো অশ্লীলতার প্রতি মানুষের মনে কোনো ধরনের কামনাও সৃষ্টি না হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, যারা মিথ্যা ও মিথ্যাচার বর্জন করে না, তাদের এ উপবাসে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাত্ মন্দ কাজগুলোকে বর্জন না করলে রোজা আর রোজা থাকে না। উপবাসে পরিণত হয়। এভাবে রোজা সব মন্দ কাজ বর্জনের শিক্ষা দেয়, যা তাকওয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
অন্যদিকে রমজান হলো অর্জনের মাস, কর্মের মাস। রমজানে প্রত্যেক দিন ২৪ ঘণ্টার কর্মের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। সারাদিন রোজা, সন্ধ্যায় বিলম্ব না করে ইফতার, ইফতারের পরই আছে মাগরিবের নামাজ। এরপর ক্লান্তিতে সারা শরীর যখন ঝিমিয়ে আসে, তখন ডাক আসে এশার নামাজের। কিন্তু অন্য সময়ের মতো কয়েক রাকাত নামাজ পড়লেই হবে না। বরং তার চেয়ে আরও ২০ রাকাত বেশি তারাবির নামাজ পড়তে হয়। এত কিছুর পরও সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই। আবার ডাক আসে : ওঠো, সাহরি খাও। সাহরিটাও ইবাদত। সাহরি খাওয়ার পর শুতে গিয়ে ফজরের নামাজ কাজা করার সুযোগ নেই। আবার ফজরের নামাজ পড়া। ফজরের পর থেকে শুরু হয় আবার সারাদিনের রোজা। এর মধ্যে কোরআন তিলাওয়াত, কোরআন অধ্যয়ন, বেশি বেশি নামাজ পড়া, জিকর করা ইত্যাদি কাজে উত্সাহিত করা হয়েছে।
রাসুল (সা.) হাদিসে কুদসিতে বলেছেন : আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষ যে কোনো ভালো করলে তার সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭শ’ গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়। কিন্তু রোজা হলো বিশেষ করে আমার জন্য। তাই আমি নিজ হাতে রোজার প্রতিদান দেব। অথবা আমি নিজেই রোজার প্রতিদান।’ অর্থাত্ যে রোজা রাখে, সে আল্লাহকেই পেয়ে যায়। আর যে আল্লাহকে পেয়ে যায়, সে সবই পেয়ে গেল। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, কেউ যদি রোজায় নফল কাজ করে, তাহলে ফরজ আদায়ের সওয়াব হয়, আর যদি কেউ ফরজ আদায় করে, তাহলে অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান পুণ্য হয়। অর্থাত্ যে কোনো ভালো করা হোক, তার সওয়াব কমপক্ষে সত্তর গুণ বেশি। অন্য সময় কেউ যদি সুন্দরভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে ভালো কাজ করে, তার সওয়াব ৭শ’ গুণও হতে পারে। আর রমজানে তা করলে আরও সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। অর্থাত্ যে কোনো ভালো কাজ পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে করলে তার সওয়াব ৪৯ হাজার গুণ হতে পারে। এভাবে রমজানে বেশি বেশি ভালো কাজ করার উত্সাহ দেয়া হয়েছে।
এভাবে সব মন্দ কাজ বর্জন আর ভালো কাজ অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আর যার মধ্যে তাকওয়া থাকে এবং তাকওয়ার সঙ্গে কোরআন অধ্যয়ন করে, তার পক্ষে কোরআন থেকে হেদায়াত পাওয়া এবং তার ওপর আমল করা সহজ হয়। এ জন্য বলা হয়েছে, কোরআন থেকে তারাই হেদায়াত পায়, যাদের মধ্যে তাকওয়া আছে।
তাকওয়া না থাকলে কোরআন থেকে হেদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই দেখা যায়, যারা তাকওয়া ও সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে কোরআন অধ্যয়ন করে না, তারা তা থেকে হেদায়াত পায় না। পাশ্চাত্যে অনেকেই কোরআন চর্চায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্য অর্জন ও পেশাগত উন্নতি। নিজ উদ্দেশ্যে তারা সফল হয়েছে। কিন্তু তাকওয়ার অভাবে হেদায়াত পায়নি, যা কোরআনের উদ্দেশ্য।
No comments :
Post a Comment