১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখে দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় একজন প্রখ্যাত আইনবিদের নিবন্ধটি পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছে। বিসমিল্লাহ খোঁজার জন্য তিনি যে কষ্ট স্বীকার করেছেন (এবং অনেক বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়েও তিনি যে বিসমিল্লাহর হদিস পাননি) এজন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কলম ধরেছেন এবং একটি নিবন্ধ লিখে ফেলেছেন এজন্যও তাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
এত বই ঘাঁটার প্রয়োজন তার ছিল না। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের প্রথম বইটি উল্টালেই বিসমিল্লাহর হদিস পেয়ে যেতেন। কারণ, বইটির সূচনাই হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা। এ পুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতেও বিসমিল্লাহ রয়েছে। এ হিসাবে তাতে ১১৪ বার বিসমিল্লাহ আছে। আর হজরত সুলায়মান (আঃ) সমকালীন সাবার রাণীকে যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পত্র লিখেছিলেন তাও তিনি শুরু করেছেন উপরোক্ত বাক্য দ্বারা (দ্র. সূরা নামল, আয়াত নং ৩০)।
সরকারি গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো দলিলের সূচনায় বিসমিল্লাহ : হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমকালীন রাজ-রাজড়াদের পত্র মারফত ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি সমকালীন বায়যানটাইন সম্রাট মহামতি হিরাক্লিয়াসের নিকট যে দাওয়াতপত্রটি পাঠিয়েছিলেন, তার সূচনাও করেছেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা। ইসলাম ও মুসলমানদের দ্বিতীয় কিতাব ‘সহীহুল বুখারী’, যা বুখারী শরীফ নামে বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ, এর প্রথম অধ্যায়ের ৭ নম্বরে হাদিসে ওই পত্রখানা উক্ত আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) পত্রখানার সূচনা করেছেন এভাবে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম। মিন মুহাম্মদিন আবদিল্লাহি ওয়া রাসূলিহি ইলা হিরাকলা আজীমির রূম’...। এমনকি বুখারী গ্রন্থখানি সূচনা হয়েছে বিসমিল্লাহ বাক্য দ্বারা।
মদিনার সনদের সূচনায় বিসমিল্লাহ : হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরত করে মদিনায় পৌঁছে এখানে একটি ক্ষুদ্র পরিসর রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা প্রধানত চারটি ধর্মের অনুসারী ছিল—মুসলিম, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তালিক। এরা ক্ষুদ্র-বৃহত্ প্রায় একুশটি গোত্র-উপগোত্রে বিভক্ত ছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের সবার জন্য অবশ্য পালনীয় একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাস ‘মদিনার সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ। এটি হলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই সংবিধানের সূচনাও করেছেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা। এই সংবিধানের প্রধান প্রধান কয়েকটি ধারা হলো :
(এক) আল্লাহ্র নবী মুহাম্মদ (সা.) হবেন এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান; (দুই) এই রাষ্ট্র শাসিত হবে আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক; (তিন) এই সংবিধানের অধীন প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ সংরক্ষিত থাকবে; (চার) ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এই রাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে; (পাঁচ) সনদভুক্ত কোনো গোত্র বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে সনদভুক্ত অন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সাহায্য করবে। (বিস্তারিত দেখুন, ইমাম ইবনে কাছীর (রা.), আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২য় ভলিউম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৩, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সং, বৈরুত ১৪০৫ হিজরি/১৯৮৫ খ্রি.। বৃহত্ চৌদ্দ খণ্ডে বিভক্ত ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত এই পুস্তকখানির সূচনাও হয়েছে বিসমিল্লাহ বাক্য দ্বারা)।
বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও শাসকদের কাছে লিখিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সব দাওয়াতপত্রের সূচনায় রয়েছে বিসমিল্লাহ। তাঁর পরবর্তী চারজন মহান রাষ্ট্রনায়কের সময় সম্পাদিত গুরুত্বপূর্ণ সনদ ও দলিলসমূহেরও সূচনায় রয়েছে বিসমিল্লাহ। এমনকি ১৭৫৭ সালে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত পূর্বকালের সকল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সনদ ও দলিলসমূহের সূচনাও বিসমিল্লাহ দ্বারা। পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন দলিলপত্রের স্তূপ অনুসন্ধান করলে বিসমিল্লাহর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
শ্রদ্ধেয় নিবন্ধকার কি বলতে চান, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার পরবর্তী চারজন মহান শাসক তাদের প্রণীত সনদসমূহে যে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছেন তারাও কি ধর্মান্ধ হয়ে হীন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ নিয়ে এত মাতামাতি করেছেন, মাতম করেছেন? নাকি ইসলাম ও মুসলমানদের প্রথা বা ঐতিহ্য হিসেবে তা ব্যবহার করছেন।
মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্য : পৃথিবীর সব জাতিরই নিজস্ব একটা ঐতিহ্য আছে। তারা এ ঐতিহ্য রক্ষার ও অনুসরণ করার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করে। একইভাবে মুসলমানরাও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষার ও অনুসরণের চেষ্টা করে। তাই প্রত্যেক মুসলমান যে কোনো উত্তম কাজ বিসমিল্লাহ দ্বারা সূচনা করে। পানাহারের সূচনায় বিসমিল্লাহ, কোথাও রওয়ানা হলে বিসমিল্লাহ এবং আরও বহু ক্ষেত্রে তারা বিসমিল্লাহ বলে শুভ সূচনা করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে কোনো কাজের সূচনায় বিসমিল্লাহ (আল্লাহতায়ালার নাম) উচ্চারণ করা না হলে তা কল্যাণশূন্য’ (মুসনাদ আহমাদ)।
বাংলাদেশের সংবিধানে বিসমিল্লাহ : বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় সংবিধানে বিবৃত নিয়ম-কানুন দ্বারা। সংবিধান যে কোনো জাতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তিধর সনদ। এই সনদের সূচনা ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ বাক্য দ্বারা শুরু হওয়া অত্যন্ত জরুরি। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী অনুসারে এটি আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না-যদি তার সূচনায় ঐক্য বাধ্য না থাকে। অতএব, সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ বাক্য বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কোনো বই বিসমিল্লাহ দ্বারা সূচনা করা হলো কিনা তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) এসব ক্ষেত্রে যে নীতি অবলম্বন করেছেন তার অনুসরণ করা। তিনি গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো লিখিত দলিলের সূচনায় বিসমিল্লাহ বাক্য যোগ করেছেন। ষ
লেখক : ইসলামি আইনবিদ
No comments :
Post a Comment