আমাদের দেশের মহিলাদের ঘাতক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম রোগ হলো ব্রেস্ট ক্যান্সার। একবিংশ শতাব্দীতে উন্নত বিশ্বে মহিলাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে ব্রেস্ট ক্যান্সারকে দায়ী করা হচ্ছে। গ্রেট ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজন মারা যায় এ রোগে । আমেরিকাতেও বছরে প্রায় ৪০ হাজার মহিলা মারা যাচ্ছে।
আমাদের দেশে এ রকম কোনো সঠিক সমীক্ষা না থাকলেও একটি সমীক্ষায় জানা গেছে বছরে প্রায় ২৫-৩০ হাজার মহিলা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ১৭-২০ হাজার মারা যাচ্ছে। ব্রেস্ট ক্যান্সারে একটা সুবিধাজনক দিক হলো এ রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে আরোগ্য করা সম্ভব। তাই আমাদের দেশের মহিলাদের সচেতন করে এই ঘাতক রোগ থেকে মুক্ত রাখা আমাদের সমাজের দায়্ত্বি। তবে সর্বাগ্রে নিজে নিজেই সতর্ক থাকা একান্ত দরকার। এক্ষেত্রে নিয়মিত নিজে ব্রেস্ট পরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং এ রোগের কারণ ও লক্ষণগুলো জানতে হবে।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ : ব্রেস্টে চাকা বা টিউমার ব্রেস্টের আকার পরিবর্তন চামড়ার রং পরিবর্তন ব্রেস্টের নিপল বা বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া বা বাঁকা হয়ে যাওয়া নিপল দিয়ে অস্বাভাবিক রস বা রক্তক্ষরণ হওয়া ব্রেস্টে ব্যথা অনুভব করা বগলের তলে টিউমার বা চাকা হওয়া ব্রেস্টের ওপর চামড়া কমলা লেবুর খোসার মতো কুঁচকে যাওয়া বা টোল পড়া নিপলের চারপাশে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া ইত্যাদি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ব্যক্তিগত ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে ৩৫ থেকে ৫০ বছরের ওপরে গেলে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে পারিবারিক ভাবে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে মেদবহুল শরীর ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত বেশি মসলাদার খাবার খাওয়া সংকটের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। অল্প বয়সে মাসিক শুরু ও অধিক বয়সে মাসিক শেষ হওয়া ,অধিক বয়সে গর্ভধারণ , একেবারেই গর্ভবতী না হওয়া , বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বয়সকালে এইচআরটি নেওয়া , উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস রোগী,মদ্যপান, ধুমপান এমনকি প্যাসিভ যারা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের দ্বারস্থ হয়েছেন, যেমন এক্স-রে।
যাদের জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হয়েছে ।যেসব মহিলামেনোপজের পর মোটা হয়ে যায় তাদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের উপায় : ব্রেস্ট সেলফ একজামিনেশন নিজে নিজে পরীক্ষা একটি সহজ এবং খরচবিহীন পরীক্ষা। ২০ বছর পার হওয়ার পর থেকেই এটি শুরু করা উচিত। এ সহজ পরীক্ষাটি আপনি মাসে একবার গোসলের পর নিজেই করতে পারেন। মাসিকের পর বা মাঝামাঝি সময় এবং মেনোপজে যারা গেছেন তারা মাসের প্রথম বা শেষ দিনটিতে করতে পারেন।
ব্রেস্ট সেলফ পরীক্ষা করার নিয়ম : প্রথমে কোমর পর্যন্ত নিজেকে অনাবৃত করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেস্ট দুটি লক্ষ্য করুন। ফোলা, লালচে ভাব, নিপলের চারপাশের রং এবং ত্বকের অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি নজরে এলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাম স্তন বাম হাতের আঙুল দিয়ে ডান স্তন ভালভাবে সামনের দিকে পাশের দিকে হাত ওপরে তুলে পরীক্ষা করুন।
স্তনের সব অংশে চাপ দিয়ে দেখতে হবে ঢেলা বা ব্যথাহীন ফোলা অংশ আছে কি-না। এ রকম কিছু অনুভব করলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন।
৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মহিলাদের ১৮ মাসের মধ্যে একবার প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে স্তন পরীক্ষা করা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে ম্যামোগ্রাফি করা দরকার। আর ৪০ বছর বয়সের পর বছরে একবার ম্যামোগ্রাপি করা একান্ত দরকার।প্রতিরোধের উপায় : শিশুকে স্তন পান বা দান করা প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রণালি প্রতিরোধের দ্বিতীয় উপায়। জীবনযাপন প্রণালি হতে হবে সহজ, অনাড়ম্বর ও শৃংখলাবদ্ধ। হালকা ব্যায়াম করতে হবে। মদ, তামাক, জর্দ্দা ও গুরুপাক চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিয়ে প্রতিদিনের তালিকায় প্রচুর শাক সবজি, মৌসুমি ফল, টমেটো, গাজর ইত্যাদি যোগ করতে হবে। কেননা এসব খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটো কেমিক্যাল থাকে যা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
চিকিৎসা : বর্তমানকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তাই রোগের প্রারম্ভেই চিকিৎসকের পরামর্শানুসারে ওষুধ সেবন করলে রোগ থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। ওরাল মেডিসিন ছাড়াও সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির সাহায্যে বেঁচে থাকা সম্ভব।
ব্রেস্ট ক্যান্সার ছোঁয়াচে কোনো রোগ নয়। ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়া মানেই মৃত্যু নয়, তবে প্রাথমিক অবস্থায় সঠিকভাবে এ রোগ নিরূপণ ও চিকিৎসার প্রয়োজন।
No comments :
Post a Comment