মেয়েদের জীবনকে ছয় ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- কৈশোর বা বয়ঃসন্ধির সময়, যৌবনকাল, গর্ভবতী মা, প্রসূতি মা, মধ্যবয়স ও বার্ধক্য। বয়সের প্রতিটি স্তরেই খাদ্যের চাহিদা বিভিন্ন ধরনের হয়।
বয়ঃসন্ধিকাল
এ সময় মেয়েদের যথাযথ পুষ্টির জন্য চাই সুষম খাবার। মাসিক ঋতুস্রাবের জন্য রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে বলে প্রোটিন ও লৌহের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রক্তস্বল্পতার কারণে দেহে আসে ক্লান্তি ও অবসাদ, ত্বকের রঙ হয় ফ্যাকাশে, চেহারা হয় বিবর্ণ, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।
লৌহের ঘাটতি মেটানোর জন্য খাবারে থাকবে টক-মিষ্টি ফল, কলিজা, ডিম, গুড়, ধনেপাতা, লেটুসপাতা, ডাল, ছোলা, মাংস ইত্যাদি। শহরে সচ্ছল পরিবারের মেয়েদের মধ্যেও দেখা যায় মারাত্নক অপুষ্টি। এর বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে দোকান বা রেস্টুরেন্টের খাবার গ্রহণ, যা ক্যালরিবহুল ও কম পুষ্টিসম্পন্ন।
খেলাধুলা, হাঁটা বা কাজকর্মের প্রতি অনীহা, বেশিরভাগ সময় টিভি, কম্পিউটার নিয়ে সময় কাটানোর ফলে দিনে দিনে ওজন বেড়ে যায়। অন্যদিকে পড়াশোনায় অত্যধিক চাপের জন্য খাবারে অরুচি বা খাবার সময় না পাওয়া বা না খাওয়া, শোবিজের প্রতি অনুরাগের কারণে মডেলদের অনুকরণ করতে গিয়ে না খেয়ে থাকার ফলে ওজন কমে যাচ্ছে।
ওজন কম থাকাটা যেমন অপুষ্টি, তেমনি ওজন বেড়ে যাওয়াটাও এক ধরনের অপুষ্টি। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত রোগ দেখা যায়। কিশোরীদের ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত দেখলে বুঝতে হবে তাদের খাদ্যে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, শাক-সবজি, ফল ও পানির অভাব হচ্ছে।
এ বয়সে কখনও ডায়েট কন্ট্রোল করা উচিত নয়। এতে ত্বক কুঁচকে যায়, চোখ ও চুলের উজ্জ্বলতা কমে যায়। চোখের নিচে কালি পড়ে, পড়াশোনা ও কাজের প্রতি উৎসাহ থাকে না। দুধ খেতে না পারলে অল্প করে দই বা ছানা খাওয়া যেতে পারে। দুধ ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস।
এ বয়সে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিসের জন্ম দেয়। এ বয়সে অনেকের শর্করা যেমন- ভাত-রুটি, পিৎজা, বার্গার, পাস্তা, নুডলস ইত্যাদির প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। সেজন্য মাত্রাতিরিক্ত শর্করা না খেয়ে খাদ্য উপাদানের অন্যসব খাবার খাওয়া উচিত।
মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য জিংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিংক পাওয়া যায় গাজর, মাংস, ডিম, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদিতে। কোমল পানীয় এড়িয়ে চলাই ভালো। মেয়েদের শরীরে ও মনে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়।
যৌবনকাল
ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের জন্য এ পরিবর্তন হয় ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার সময় থেকে। এ সময় ব্রণের জন্য অনেকেই বিব্রতবোধ করে। মেয়েদের ব্রণ হয় সাধারণত ১৪-১৬ বছর বয়সের মধ্যে। সেজন্য কড়া মশলাযুক্ত ও ভাজা খাবার পরিহার করে চলতে হবে। খেতে হবে শাক-সবজি, ফল, ফলের রস ও পর্যাপ্ত পানি।
খাবার হবে সহজপাচ্য। কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয়, সেজন্য আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ৫-৬ বার নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। জাংক ফুড এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। ওজন বেশি থাকলে লো-ক্যালরির ডায়েট যেমন- শসা, ফল, দইয়ের পাতলা সরবত, দুধবিহীন চা, সবজির স্যুপ, সালাদ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
গর্ভাবস্থা
এ মায়েদের খাবার অন্য মহিলাদের চেয়ে পৃথক হবে। কারণ ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য তার খাবারের পরিমাণ বাড়বে। তবে মাত্রাতিরিক্ত খাবার না খেয়ে পুষ্টিসম্মত খাবার প্রয়োজন। প্রতিদিন বরাদ্দকৃত ক্যালরির চেয়ে ৩০০ ক্যালরি বেশি খেতে হবে। এ ক্যালরি আসবে- দুধ, মাছ, মাংস, ডাল থেকে।
এ সময় প্রয়োজন ছোট ও বড় মাছ, ডিম, দুধ, বাদাম, মাংস, শিমের বীচি, টমেটো, শাক, ডাল, আমলকী, পেয়ারা, আমড়া ইত্যাদি। রক্তস্বল্পতা রুখতে প্রয়োজন কচুর শাক, সবুজ শাক-সবজি, শুকনো ফল, গুড়, কলিজা, লালশাক, টকফল ইত্যাদি। ফলিক এসিডের জন্য প্রয়োজন সবুজ পাতা জাতীয় সবজি, ঢেঁড়স, বরবটি, কলিজা, ডিম, লেটুসপাতা ইত্যাদি।
প্রসূতি মা
বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা যেন ঠিকমতো খাবার খেতে পারেন সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ এসময় বুকের দুধের জন্য মাকে আমিষ জাতীয় খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। যদি ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তাহলে শর্করা যেমন ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি খাওয়া সীমিত করতে হবে।
পান করতে হবে পর্যাপ্ত পানি এবং পানীয়। তরকারি হবে ঝোলসহ। এতে মায়ের দুধের প্রবাহ ঠিক থাকবে। প্রসবের পর অনেকের মুখে কালো ছোপ পড়তে দেখা যায়, এটা হয়ে থাকে ক্যালসিয়াম ও লৌহের অভাবে। এজন্য খাবারে ক্যালসিয়াম, লৌহ ও প্রোটিন সংযোজন করতে হবে। খেতে হবে গাজর, ফুলকপির স্যুপ, মুরগির স্যুপ, ছোলা, দুধ, ধনেপাতা, পুদিনাপাতার চাটনি, সরষে শাক, পিঁয়াজ কলি ইত্যাদি।
মধ্যবয়সী নারী
একজন মা সংসারের চালিকাশক্তি। যদি মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকে তবে পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব নয়। কথায় আছে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ, সবই মাকে করতে হয়। এ বয়সে শরীর বৃদ্ধির ব্যাপার না থাকলেও স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন।
বাড়িতে যারা গৃহস্থালীর কাজ করেন তাদের খাবার হবে যারা কম পরিশ্রম করেন, তাদের চেয়ে বেশি। তবে উভয় ক্ষেত্রেই খাবার হতে হবে পুষ্টিসম্মত। মিষ্টি-মিষ্টান্ন ও ভাজা খাবার বাদ দেয়াই ভালো। রাতের খাবার দুপুরের তুলনায় কম হওয়া উচিত। কারণ রাতে পরিশ্রম কম করতে হয় বলে ক্যালরি খরচও কম হয়।
এদিকে দেহের মেটাবলিক রেট কমে যায় বলে ক্যালরির পরিমাণও বেড়ে যায়। যদি কারও ওজন কম থাকে তা হলে খেতে হবে দিনে ১৬০ গ্রাম মাছ বা মাংস, ১টি ডিম, ১টি কলা, ২৫০ মি.লি. দুধ, মাখন, পানীয় ইত্যাদি। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে সরবত, খেজুর, বাদাম, কিসমিস খাওয়া যেতে পারে।
বার্ধক্য
বার্ধক্যকে দূরে রাখতে হলে প্রয়োজন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। যা পাওয়া যায় ভিটামিন ই, সি , এ ও জিংক থেকে। প্রতিদিন ১টি আমলকী অকাল বার্ধক্য রোধ করে। চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ও কালো ভাব বজায় রাখতে আমলকী প্রয়োজন। অনেকের ধারণা শরীর ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন প্রচুর আমিষ। এটা ঠিক নয়। আমিষ খুব কম খাওয়া যেমন ক্ষতিকর তেমনি অতিরিক্ত আমিষও বিপদ ডেকে আনতে পারে।
No comments :
Post a Comment