আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর আগে পবিত্র মক্কা নগরীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হিদায়াতের আলো দিয়ে পাঠান। এ মহামানবকে যে আরব ভূখণ্ডে পাঠানো হয় সে অঞ্চলের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন-পূর্ব সময়কে কোরআনে হাকিমে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা তমসা, অজ্ঞতা, বর্বরতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নের যুগ বলা হয়েছে। কারণ, তত্কালীন আরব সমাজ ছিল নানা কুসংস্কার, অনাচার-অত্যাচার ও কুফরীর ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মারামারি, কাটাকাটি, খুন-খারাবি, অপহরণ, ধর্ষণ, স্বাধীন নর-নারী ও শিশুকে জোরপূর্বক বিক্রি, রাজা-বাদশাহ ও গোত্র প্রধানকে পরম পূজনীয় ধারণা, অতিতুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ, বিবাহ, তালাক ও ক্রয়-বিক্রয়ে অদ্ভুত প্রথার অনুসরণ, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থকরণ, মদ্যপান, জুয়া, সুদ, ঘুষ, দেব-দেবীর নামে পশু উত্সর্গকরণ, খাদ্যদ্রব্য দিয়ে তৈরি মূর্তিকে সাদরে ক্ষুধার তাড়নায় ভক্ষণ, বহুবিবাহকরণ, বিবস্ত্র অবস্থায় কা’বা শরীফ তাওয়াফ, বিভিন্ন মূর্তির নাম সংযোজন করে তালবিয়া পাঠ, বেচাকেনা ও লেনদেনে নানা প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বন, আভিজাত্যের অহমিকা ও বর্ণবৈষম্য প্রভৃতি কুসংস্কারের ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল তত্কালীন সমাজজীবন।
এ ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়ে ঘোষণা দেন যে তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসুলকে সঠিক পথ ও সঠিক তথা সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব মতবাদের ওপর এ ধর্ম তথা মতবাদ বিজয়ী হতে পারে।’ (সূরা : তাওবা, আয়াত : ৩৩)। মহানবী (সা.) অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে ঘোর অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত এনে সে সমাজে ইসলামের সুবিমল জ্যোতি বিকীরণ করেন। তিনি নবুয়াত প্রাপ্তির আগেই যাবতীয় কুসংস্কার সমাজ থেকে কীভাবে দূর করা যায় সে নিয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। নবুয়াত প্রাপ্তির পর তিনি তাঁর দাওয়াতি মিশনের সূচনায় জাহেলি যুগের সব কুসংস্কারকে পরিহার করে এক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলেন। কিন্তু অনেকে তাঁর ডাকে সাড়া দিলেও বাকিরা তাঁর উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। অবশেষে আল্লাহর হুকুমে তিনি মদিনায় হিজরত করেন।
তিনি মদিনায় হিজরত করে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দেয়ার লক্ষ্যেই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদের’ আলোকে তথায় এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন, যাতে উপরোল্লিখিত কোনো কুসংস্কারের বালাই ছিল না। সেখানেই আল্লাহতায়ালা যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুমিনদের মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন—‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া ও মূর্তি পূজার বেদি এবং ভাগ্য নির্ণয়কারী শরঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা : মায়িদা, আয়াত : ৯০)।
এরপর থেকে যারা ইসলামের মূলমন্ত্রকে তখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছে তারা তাদের পূর্ব স্বভাবজাত নানা অপকর্ম ও অন্ধবিশ্বাসকে নিজেদের মন-মগজ থেকে আজীবনের জন্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-এর বাতানো পথে থেকে পরিশুদ্ধ জীবনযাপন শুরু করে। তারপর দেখা যায় অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়কালে মহানবী (সা.) পবিত্র কাবায় রক্ষিত ৩৬০ মূর্তিকে ধ্বংস ও অপসারণের মাধ্যমে পৌত্তলিকতার মূলে চূড়ান্ত আঘাত হানেন। তাঁর নবুয়াতি মিশনের উদ্দেশ্যই ছিল সব কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিয়ে তাওহিদের কালেমাকে বুলন্দ করে। তিনি এ মিশনে সফলও হয়েছেন। মোট কথা, তাওহিদের আলোকে মানুষের মধ্যে সর্ববিধ পরিবর্তনের মাধ্যমে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম বিশ্বের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব সংস্কারধর্মী বিপ্লবের সূচনা করে সাফল্য অর্জন করে গেছেন, তা সত্যিই অনন্য ও নজিরবিহীন।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ‘আমরা নিজেদের যে নবীর উম্মাত বলে পরিচয় দিই সে নবীর জীবনাদর্শ আমাদের কাছে চরমভাবে উপেক্ষিত। আজ নোংরা সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল ফণা বিস্তার করেছে মুসলিম সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সর্বত্রই যেন অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও কুসংস্কার সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত করছে। আজ হত্যা, ধর্ষণ, খুন-খারাবি, অপহরণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, অত্যাচার, অনাচার, সম্পত্তি আত্মসাত্ প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন আমাদের সমাজের মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতার নামে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম তথা তরুণ-তরুণীরা ফ্রি মিক্সিং, লিভ টুগেদার, তথাকথিত ভ্যালেনটাইন ডের সুযোগে অবাধ মেলামেশা, অবৈধ সম্পর্ক, নগ্নতা, অশ্লীলতা প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত। আধুনিক যুগে তথাকথিত ফ্যাশনের নামে নারী মূর্তি তৈরি, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, নারীদের মডেল হিসেবে ব্যবহার, মানুষ পশু-পাখির ছবি অঙ্কন ও প্রতিকৃতি নির্মাণ চলছে অহরহ। এ ধরনের হাজারো কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে আমাদের সমাজে। দিন দিন যেন বিজাতীয় সংস্কৃতি, নানা অপকর্ম, প্রথা-পদ্ধতি, নতুন নতুন অনুষ্ঠানাদির তালিকা আমাদের সমাজে বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমরা কি একটি বারের জন্যও ভেবে দেখেছি এগুলো কিসের আলামত?’
আমরা নিজেদের স্বাতন্ত্রবোধ ও স্বকীয়তাকে হারিয়ে রাসুল (সা.)-এর আদর্শের তোয়াক্কা না করে নব্য জাতিবিধ্বংসী প্রভুদের খুশি করার জন্য বিশ্বাসী জীবনধারা পরিত্যাগ করে, পরকালকে ভুলে দুনিয়ার মোহে ডুবে গিয়েছি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার সব উম্মতই জান্নাতে যাবে অস্বীকারকারী ব্যতীত। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, অস্বীকারকারী কে?’ জবাবে তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকারকারী।
অতএব, আমাদের উচিত ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যেসব অন্যায় ও অপসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে তা উত্খাত করার চেষ্টা চালানো। এ জন্য বিশ্বসংস্কারক মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুকরণ ও অনুসরণের বিকল্প নেই। কেননা রাসুল (সা.)-এর আদর্শের বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি। আল্লাহর ভাষায় : ‘নিশ্চয়ই রাসুল (সা.)-এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সূরা : আহযাব, আয়াত : ২১)
No comments :
Post a Comment