
আমাদের সমাজে যারা ইসলামের ওপর চলতে চায় তাদের মধ্যে প্রায়ই পারস্পরিক সম্পর্কের অভাব দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ সম্পর্কহীনতার পেছনের কারণ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষয়িক নয়। বরং এর পেছনের কারণ হচ্ছে দ্বীনদারির ইস্যু। অর্থাত্ দ্বীনদারি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদের পরিণতিতে সম্পর্কের অবনতি বা সম্পর্কছেদ। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। দ্বীনদার ভাইদের মধ্যে দ্বীনদারিতে নিষ্ঠা থাকলেও দ্বীনদারির ধরনে পার্থক্য থাকতে পারে। সবাই শরিয়তের পাবনদি করলেও শরিয়তের বিভিন্ন বিষয় এবং ইস্যুর ক্ষেত্রে গুরুত্বের তারতম্য থাকতে পারে। কেউ হয়তো দ্বীনদারি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য মাদ্রাসায় পড়াকে জরুরি ভাবছেন, আবার আরেকজন ভাবছেন দ্বীনদারির জন্য মাদ্রাসায় পড়া জরুরি নয়। সাধারণ শিক্ষা দিয়েও পারিবারিক তত্ত্বাবধানে দ্বীনদারি রক্ষা করা সম্ভব। আবার অন্যজন ভাবছেন তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম ছাড়া দ্বীনদারি থাকতেই পারে না। আরেকজন মনে করেন, যেহেতু অনৈসলামিক শাসনে থেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মানা সম্ভব নয়, তাই ইসলামী শাসন তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী রাজনীতি করতে হবে। কেউ বিশ্বাস করেন, হক্কানি পীর-বুজুর্গের বাইয়াত ও সাহচর্য ছাড়া দ্বীনদারি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এরকমভাবে আকিদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণায় পার্থক্যের কারণে দ্বীনদারির পাবনদির ক্ষেত্রে বহু মত ও পথ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। উল্লিখিত বিষয় ছাড়াও আরও অনেক হালকা বিষয়েও মতপার্থক্য দেখা যায়। যেমন—পোশাক-পরিচ্ছদ, চেহারা-অবয়ব (Appearance), মহিলাদের বোরকার ধরন, নামাজ শেষে দোয়া, মিলাদ পড়া ইত্যাদি। বিষয়গুলোয় অনেক দ্বীনদার ভাই এত বেশি সংবেদনশীল (Sensitive) এবং অনমনীয় (Rigid) থাকেন, দুই মতের দুই ভাইয়ের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দূরে থাক, রীতিমত বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সম্পর্কও গৌণ হয়ে যায়। এসব বিষয়ে দেখা যায়, নিজ মতের না হলে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গেও সম্পর্ক থাকে না।
মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কখনও এমন বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, মনে হয় যেন মতবিরোধকারী দু’জন একসঙ্গে এক বেহেশতে যেতেও রাজি নন। অথচ দু’জনই চান শরিয়তের ওপর চলতে, ইসলামকে মানতে। গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, অনেক সময় এমনও দেখা যায় ভিন্নমত পোষণ করায় এক মতের অনুসারী ব্যক্তি অন্য মতের অনুসারীর সঙ্গে কোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্কও রাখেন না, অথচ সে ব্যক্তিই, দ্বীনের প্রতি উদাসীন/তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকারী বা ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক/অর্ধনাস্তিক ব্যক্তিদের সঙ্গে দিনরাত ওঠাবসা করেন এবং গভীর সম্পর্ক রেখে চলেন। দ্বীনদারি তথা ইসলামের ইস্যু নিয়ে বৈরিতার চরম পর্যায় হলো, ভিন্নমত পোষণকারীদের ইহুদিদের চর, খ্রিস্টানদের এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণকারী অন্য মুসলমান ভাইদের ভণ্ড নবীর অনুসারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিয়ে একাকার করতেও দেখা যায়। অথচ যত ভিন্নমতই পোষণ করুক না কেন, যদি না কেউ (হক্কানি ওলামাদের মতে) ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়, তবে কাফেরদের সঙ্গে তাকে তুলনা করাটা কতটা গর্হিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাফের বললে দু’জনের একজন কাফের বলে গণ্য হবে। অর্থাত্ যাকে কাফের বলা হলো, সে যদি প্রকৃতপক্ষে কাফের না হয় তাহলে যে ব্যক্তি অন্য মুসলমানকে কাফের বলল সে-ই কুফরি করল। কত ভয়াবহ কথা!
দ্বীনদারি বিষয়ে বিশ্বাস, ভাবনা (perception), ধ্যান-ধারণা (concept), অনুশীলন, আচার-আচরণ (practice), প্রচলন (tradition), সংস্কৃতি (culture) ইত্যাদি ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকবেই। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব বিবেচনা করে যদি ভিন্নমতকে উদারতার সঙ্গে নিয়ে সহনশীলতার অনুশীলন করা যায় তবেই ভিন্নমতের সহাবস্থান সম্ভব। প্রত্যেক মতানুসারীর মনে রাখতে হবে, অন্য সব মুসলমানকে তার মতের অনুসারী বানানো সম্ভব নয়। তাছাড়া তাদের মতোটাই যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ, সে রকম কোনো নিশ্চয়তা ওহির মাধ্যমে পাওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং ভিন্নমতকে দমন করার চেষ্টা অযৌক্তিক। বরং ভিন্নমতকে নিয়েই কীভাবে সহাবস্থান করা যায়—সেটাই ভাবতে হবে।
মতপার্থক্য যেন বৈরিতা বা বিদ্বেষের সৃষ্টি না করে। মতপার্থক্য থাকলেও আমরা তো সবাই একই কালিমা পড়ছি, পাঁচওয়াক্ত নামাজই পড়ছি, কেউ চার বা ছয় ওয়াক্ত পড়ছি না, একই সঙ্গে রোজা রাখছি, একই সঙ্গে হজ করছি, জাকাত দিচ্ছি, একই গোরস্থানে আমাদের দাফন হচ্ছে, একে অপরের জানাজাও পড়ছি, দ্বীনদারির কোনো ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বা তুমুল ঝগড়া করেই আবার হয়তো একই মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছি, নামাজ শেষে সব মুসলমানের জন্য দোয়াও করছি। তাহলে কেন এত বৈরিতা, উদারতার কেন এত অভাব?
কোরআনে মুসলমানদের ভাই ভাই বলে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা কি শুধু নিজ মত পোষণকারী মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? হিংসা-বিদ্বেষ ছেড়ে সব আল্লাহর বান্দাকে ভাই হিসেবে থাকার যে তাগিদ হাদিস শরীফে এসেছে তা কি ভিন্নমতানুসারী মুসলমান ভাইয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়? আমরা যখন দোয়া করি, ‘হে আল্লাহ! সব মুসলমানকে ক্ষমা করে দাও’, ‘সব মুসলমানের জানমালের হেফাজত কর’ ইত্যাদি—তখন কি শুধু নিজ মতের অনুসারীদেরই শামিল করি? বাকিদের বাদ দিয়ে দিই? এতটা সঙ্কীর্ণতাও কি সম্ভব? আমরা যদি সব সঙ্কীর্ণতা, রক্ষণশীলতা এবং অসহিষ্ণুতা ছেড়ে সব মুসলমানকে ভাইরূপে গ্রহণ করতে পারি, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবেই আমরা হব শক্তিশালী ও সৌভাগ্যবান এবং সৃষ্টি হবে শান্তিময় পরিবেশ। আর আমরা পাব পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী আমলের পুরস্কার। সেই সঙ্গে ইসলামের শত্রুদের মুখও বন্ধ হবে। আমাদের রেষারেষির সুযোগে ভ্রাতৃত্ব নষ্টের যে প্রচেষ্টা ওরা করে থাকে সেটাও ব্যর্থ হবে।
No comments :
Post a Comment