Blogger Tricks

রোজা : দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির নিয়ামক


সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত হলো মানুষ। কাজেই আল্লাহ্পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছেন, যা পালনের মাধ্যমে মানুষ জাগতিক ও আত্মিক উন্নতি লাভ করতে পারে। এমন ধরনের একটি ইবাদত হলো রোজা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অতি ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও পানাহার থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত কঠোর কাজ। সঙ্গে সঙ্গে বৈধ হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকাও একটি কঠোর পরীক্ষা। এ কঠোর নিষেধাজ্ঞার পেছনে রয়েছে বান্দার দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির এক বাস্তব প্রশিক্ষণ, যা অন্য কোনো পন্থায় অর্জন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। রোজার দ্বারা দৈহিক যে পরিশুদ্ধি ও উন্নতি লাভ করা যায় তা হলো এই যে, মানুষ যেসব খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তা পাকস্থলিতে পৌঁছার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে হজম হয়ে যায়। সারা বছর পাকস্থলি একইভাবে ক্রিয়াশীল থাকায় এর ভেতর এক প্রকার বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনিষ্টকর। বছরে একমাস রোজা রাখার কারণে বিষাক্ত গ্যাস দূরীভূত হয়ে যায় এবং পাকস্থলী শক্তিশালি হয়। যার ফলে রোজার পরে রোজা পালনকারীদের ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়, স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
এছাড়া সারাদিন অভুক্ত থাকার পর ইফতারের সময় যা কিছু পানাহার করা হয় তা অতি সহজেই হজম হয়ে যায়, আবার রাতে এশার নামাজের সঙ্গে বিশ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করার পর দেহ ও মন উভয়ই খুব হালকা অনুভব হয় এবং দেহে নতুনভাবে শক্তি ও সজীবতা সৃষ্টি হয়। এমনিভাবে এক মাস রোজা রাখার পর দেহে বিশেষ শক্তি ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বেশকিছু রোগ মানুষের জীবন ধারণ প্রণালী ও কুঅভ্যাসের কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন—ধূমপান, মদ্যপান ও মাদকাসক্তির কারণে ক্যানসার, টিউমার, যকৃতের প্রদাহ, গনোরিয়া, সিফিলিস ও মরণব্যাধি এইড্স্ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। রোজার কারণে আহারে পরিমিতিবোধ এবং ধূমপান ও মদ্যপান থেকে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিরত থাকে। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন করার ফলে এসব ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ করা অতি সহজ হয়ে যায় এবং মারাত্মক ব্যাধির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে দেহ পরিশুদ্ধি লাভ করে।


কেউ বলতে পারে যে, রোজার কারণে সারাদিন উপবাস থাকলে গ্যাস্ট্রিক বা উদরাময় রোগ হতে পারে। এটা মূলত আত্মপ্রবঞ্চনামূলক কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ রোজা রাখা বা উপবাসের কারণে কখনও গ্যাস্ট্রিক হয় না। বরং সামান্য পরিমাণ এ রোগ থাকলেও রোজার কারণে তা অনেক সময় পূর্ণাঙ্গ আরোগ্য হয়ে যায়। তবে পূর্ব থেকেই যদি মারাত্মক ধরনের গ্যাস্ট্রিক আলসার থাকে, তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা পরিত্যাগ করার বিধানও ইসলামে রয়েছে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হয় অথবা ভ্রমণে বের হয় (এবং রোজা রাখা কষ্ট হয়) তবে সে পরবর্তী সময়ে ওই রোজা পূরণ করবে। এছাড়া দৈহিকভাবে মানুষের ওপর কষ্ট হবে এমন কোনো ইবাদত আল্লাহ তায়ালা কখনও কারও উপর চাপিয়ে দেননি।


রোজার বহুবিদ উপকারিতার মধ্যে রয়েছে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ। সব ইবাদতের মধ্যেই কিছুটা রিয়ার অবকাশ থাকে। রোজা এমন একটি ইবাদত যেখানে রিয়ার সামান্যতম সুযোগ নেই। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি যাদের পূর্ণাঙ্গ ঈমান রয়েছে এবং যারা খোদাভীরু শুধু তারাই রোজা রাখতে সক্ষম হয়। কেননা, সারাদিন রোজা রাখার ফলে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার প্রচণ্ডতা যখন বৃদ্ধি পায় এবং স্বীয় গৃহে বহুবিধ উপাদেয় খাদ্য ও পানীয় মজুদ থাকা সত্ত্বেও তখন রোজাদার একমাত্র আল্লাহর ভয়ে তা গ্রহণ করেন না। কারণ তিনি এটা বিশ্বাস করেন যে, অন্য কেউ প্রত্যক্ষ না করলেও সর্বদ্রষ্টা আল্লাহ সবকিছু দেখেন। আল্লাহ পাকের প্রতি এ অগাধ বিশ্বাসের কারণে তিনি একজন খাঁটি মোমেন ও আল্লাহভীরু হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারেন। তাই হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, বান্দা একমাত্র আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পানাহার পরিত্যাগ করেছে, তাই আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।


হাদিসে বর্ণিত আছে, রোজা হলো ঢালস্বরূপ। ঢাল যেমন মানুষকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে তেমনি রোজাও মানুষকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, রোজা অবস্থায় যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় অথবা ঝগড়া করে তবে তাকে বল, আমি রোজাদার, আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না। এ অবস্থায় নিশ্চয়ই কেউ গালি দেবে না অথবা ঝগড়া করতে এগিয়ে আসবে না। কাজেই রোজার মাধ্যমে মানুষ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাত্সর্য তথা ষড়রিপুকে দমন করতে সক্ষম হয় এবং রোজাদার একজন পরিপূর্ণ মুত্তাকি ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিগণিত হয়।
অপরপক্ষে আত্মিক উন্নতি ও পরিশুদ্ধির কারণে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু শয়তান কোন প্রকৃত রোজাদারকে কুমন্ত্রণা দিয়ে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। কারণ রোজা পালনের কারণে মু’মিন মনে মনে এ ধারণা পোষণ করে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে সর্বদা দেখছেন। কাজেই শয়তানের কুমন্ত্রণায় একজন রোজাদার কখনও গৃহে রক্ষিত উপাদেয় খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে অথবা কামভাব চরিতার্থ করতে প্রবৃত্ত হয় না।
আল্লামা ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেছেন, রোজার তিনটি স্তর রয়েছে :


১. সর্বসাধারণের রোজা, ২. বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা, ৩. উঁচুস্তরের ব্যক্তিদের রোজা। সর্বসাধারণের রোজা হলো চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পানাহার ও ইন্দ্রিয়ের কামনা থেকে বিরত থাকা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা হলো চোখ, কান, জিহ্বা, হাত, পা এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে পাপ কাজ থেকে মুক্ত ও বিরত রাখা। তৃতীয় স্তরের রোজা হলো পানাহার ও কামভাব থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে চোখ, কান, জিহ্বা, হাত, পা এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে পাপ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এবং মনকে যাবতীয় কুচিন্তা এবং বৈষয়িক দুশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকা। একমাত্র কিছুসংখ্যক উঁচুস্তরের ব্যক্তিই এ স্তরের রোজা পালন করে থাকেন। আল্লাহ এবং আল্লাহর দীন ছাড়া জাগতিক যে কোনো ধরনের চিন্তা, এমনকি পরকালের পুরস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনা করাও তাদের জন্য রোজা ভঙের কারণ। যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে উঁচুস্তরে পৌঁছেছেন তাঁদের মতে, যারা পরকালের চিন্তায় দিন অতিবাহিত করে তারাই রোজা ভঙ্গকারীদের দলে থাকে। মূলত জাগতিক দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মহান আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার অনুশীলন করাই হচ্ছে তৃতীয় স্তরের রোজা। আল্লাহর পয়গম্বর, সুফি-সাধক, দরবেশ ও অলিরা এ রোজা পালন করেছেন এবং পালন করে থাকেন। মহাত্মা ইমাম গাজ্জালি (র.) তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘আখলাকে ইলাহী তথা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করে তোলাই হচ্ছে সিয়ামের উদ্দেশ্য। সিয়াম মানুষকে ফেরেশতাদের অনুকরণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজ প্রবৃত্তির গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। কেননা, ফেরেশতারা সব চাহিদা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং মানুষের মর্যাদাও হচ্ছে পশুর চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে। কেননা, জৈবিক চাহিদা মোকাবিলা করার জন্য তাকে দান করা হয়েছে বিবেক ও বুদ্ধির আলো। অবশ্য এদিক দিয়ে তার স্থান ফেরেশতাদের নিচে। জৈবিক চাহিদা ও পাশবিক কামনা অনেক সময় তার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং তার ভেতরের এ পশুত্ব দমন করতে তাকে কঠোর সাধনা ও মুজাহাদা করতে হয়। তাই মানুষ যখন পাশবিক ইচ্ছার সুতীব্র স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় তখন নেমে যায় অধঃপতনের নিম্নতম স্থানে; অরণ্যের পশু আর লোকালয়ের মানুষে তখন কোন প্রবেধ থাকে না। আর যখন সে তার পাশবিকতা দমন করতে সক্ষম হয় তখন তার স্থান নির্ধারিত হয় নূরের ফেরেশতাদের ওপর। (ইয়াহইয়াউল উলুম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১২)


১. আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেছেন, সিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। জৈবিক চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। ক্ষুধা-পিপাসার কারণে জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছাতে ভাটা পড়ে, পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং দারিদ্র্যপীড়িত অগণিত আদম সন্তানের অনাহারক্লিষ্ট মুখ তখন তার অন্তরে সহানুভূতির উদ্রেক করে। অন্তর বিগলিত হয় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায়।

No comments :

Beingbd moved as sohoz-tech